এম মনসুর আলী :: নারীর অগ্রযাত্রা থেমে নেই। নারীরা এখন পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে চলছেন। তারা তাদের যোগ্যতার ছাপ রেখে চলেছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। তাদেরই একজন ডা. নুজহাত চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং প্রজন্ম একাত্তরের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। লেখক, উপস্থাপক, সুবক্তা, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, বুদ্ধিজীবী, সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমিক, নতুন প্রজন্মের আলোকবর্তিকা এরকম অসংখ্য গুণের সমষ্টিই ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা।
নতুন প্রজন্মের পথপ্রদর্শক ডা. নুজহাত চৌধুরী একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে। ডা. আলীম চৌধুরীর সুযোগ্য দুই কন্যা, ফারজানা চৌধুরী নীপা এবং নুজহাত চৌধুরী শম্পা। তাদের মধ্যে নুজহাত চৌধুরী শম্পা ছোট। শিক্ষাবিদ, লেখক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী তার স্বার্থক গর্ভধারিণী। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলেন ডা. নুজহাত চৌধুরী। জীবনের প্রারম্ভে প্রিয় বাবাকে হারান মুক্তিযুদ্ধের শেষান্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ে। বিধবা, অসম সাহসী, সংগ্রামী মা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীকে দেখে শিখেছেন সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার কৌশল এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার দৃঢ়তা। তার পৈতৃক ভিটা কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে।
ডা. নুজহাত চৌধুরীকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা। তিনি বলে বেড়ান মুক্তিযুদ্ধের কথা বিভিন্ন প্রাঙ্গণে, বিভিন্ন প্রান্তরে। বলে যান অবিরাম সেই বীরত্বের কথা, শোকের গাঁথা, সেই অসাম্প্রদায়িক মানবিক দেশের স্বপ্নের কথা। ভবিষ্যৎতের বাংলাদেশ যেন আর ভুলে না যায় তার ইতিহাস, যেন আর পথ না হারায়, যেন শ্রদ্ধা করে তার সূর্যসন্তান পূর্বপুরুষদের আর হয়ে ওঠে অহঙ্কারী, আত্মপ্রত্যয়ী_ এই আশায় দীপ্ত কণ্ঠে বলে যান মুক্তিযুদ্ধের কথা। বলে যেতে চান আজীবন। তরুণদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের শোক গাথা ছড়িয়ে দেয়াই তার জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাংলার মাটিতে জয়যুক্ত করতেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন উপজেলায়, জেলায়, শহরে, উপশহরে এমন কি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। তার লেখালেখি মূলত সেই আদর্শ প্রচারের আরেকটি অস্ত্র। বিভিন্ন পত্রিকায় ও অনলাইনে লেখেন এই একই বিষয়ে। ‘এ লড়াই অনিবার্য ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার লেখা একটি অসাধারণ বই।
ডা. নুজহাত চৌধুরীর শৈশব কেটেছে ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার উদয়ন স্কুলে। এ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজে। এইচএসসি পাসের পর চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে সফলতার সঙ্গে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তারপর এমএস (অপথালমোলজি) করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ভিট্টিও-রেটিনা বিষয়ে ফেলোশিপ করেন দেশে ও ভারতের বিখ্যাত হাসপাতাল এলভি প্রসাদ আই ইনস্টিটিউট থেকে। নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। নারীদের সাফল্যের খবর আমাকে প্রেরণা জোগায়। চারদিকে তাকালে দেখবেন, পোশাক শ্রমিক থেকে শুরু করে উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা_ সব ধরনের পেশাতেই নারীরা সাফল্য দেখাচ্ছেন।
ডা. নুজহাত চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু করেন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে প্রায় ৯ বছর কাজ করেছেন। এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগে। বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ অপথালমোলজি সোসাইটির বিনোদন সম্পাদক এবং একাডেমি অব অপথালমোলজির কোষাধ্যক্ষ। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ইংরেজি ও বাংলায় নিয়মিত কলাম লিখেন ডা. নুজহাত চৌধুরী। টেলিভিশনেও চিকিৎসাবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন।
ডা. নুজহাত চৌধুরী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং প্রজন্ম একাত্তরের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব তার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী। কর্মব্যস্ত এই মানুষটির অবসর নেই বললেই চলে। ব্যক্তিজীবনে তিনি বিবাহিত। স্বামী ডা. মামুন আল মাহতাব একজন লিভার বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী। তিনি বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে শুধু কাঁদান না, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করেন। তিনি নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা ও অহঙ্কার। মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা… তরুণদের স্বপ্নদ্রষ্টা।